বিলাল হোসেন মাহিনী॥ সময় আল্লাহর বিরাট নেয়ামত। আর যে কোনো নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে মহান আল্লাহ তায়ালা উক্ত নেয়ামত বাড়িয়ে দেন। পৃথিবীর শুরু থেকেই আল্লাহ তায়ালা চাঁদ-সূর্য, আকাশ-বাতাস, গ্রহ-নক্ষত্র সব কিছুকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পরিচালনা করে আসছেন। সূর্য প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে উদিত হয়, আবার নির্দিষ্ট সময়ে অস্ত যায়। যার দ্বারা সময়ের গুরুত্ব খুব সহজেই বোঝা যায়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই নামাজ মুসলমানদের ওপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরজ।’ (সুরা নিসা : ১০৩)। এ ছাড়া শরিয়তের বিধিবিধানের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ইসলামের প্রতিটি ইবাদতের জন্য আল্লাহ একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। হজ নির্দিষ্ট সময় পালন করার জন্য নির্ধারণ করেছেন, জাকাত নির্দিষ্ট পরিমাণ মাল হলে নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করার জন্য নির্ধারণ করেছেন, ফরজ নামাজের জন্যও একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করেছেন। এভাবে শরিয়তের অন্যান্য আহকামের মাঝেও সময়ের মালা গাঁথা রয়েছে।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের একাধিক জায়গায় দিন-রাতের কসম করেছেন। রাতদিনের কসম করে বলেছেন, ‘শপথ রাতের, যখন তা আচ্ছন্ন করে। শপথ দিনের, যখন তা উদ্ভাসিত করে।’ (সুরা আল লাইল : ১-২)। এখানে রাত ও দিনের কসমে বান্দাদের কল্যাণের চিন্তা ও গবেষণার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। ফজর ও ১০ রাতের কসম করে এরশাদ করেছেন, ‘শপথ ফজরের, শপথ ১০ রাতের।’ (সুরা ফজর : ১-২)। অন্য আয়াতে এরশাদ হচ্ছে, ‘শপথ সকাল ও পূর্বাহ্নের; শপথ রাতের, যখন তা গভীর হয়।’ (সুরা দোহা : ১-২)। সময়ের কসম করে এরশাদ করেছেন, ‘সময়ের শপথ, নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত।’ (সুরা আসর : ১-২)। এসব আয়াত দ্বারা সময়ের প্রতি অপরিসীম গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
নবী মুহাম্মাদ (সা.) প্রতিদিন সকালে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আজ দিনের প্রথম অংশকে আমার জন্য উপকারী বানিয়ে দিন, তার মধ্যাংশকে সাফল্যমন্ডিত করুন এবং শেষাংশকে শুভ করুন।’ অসংখ্য হাদিসে সময়ের মূল্য ও জীবনের গুরুত্ব প্রদানের তাগিদ রয়েছে। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয় আসার আগে গনিমত মনে করো; (১) বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, (২) অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, (৩) দাি দারিদ্রের আগে সচ্ছলতাকে, (৪) কর্মব্যস্ততার আগে অবকাশকে এবং (৫) মৃত্যুর আগে জীবনকে।’ (সুনানে বায়হাকি : ১০২৪৮)।
সময় মুমিন জীবনের অমূল্য সম্পদ : পার্থিব জীবনে মোমিনের মূল পুঁজি সামান্য কিছু সময়। সময় কল্যাণের পথে ব্যয় ও সময় থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টাকারীর জন্য দুনিয়া ও পরকালে সুসংবাদ রয়েছে। সময়ের সঠিক ব্যবহারে শিথিলতা প্রদর্শন করা জীবনের মূল পুঁজি ধ্বংসের নামান্তর। সময়ের সঠিক ব্যবহার মুমিনকে জান্নাতের সুউচ্চ আসনে পৌঁছে দিতে পারে। অপরদিকে সময়ের অবহেলায় নিক্ষিপ্ত হতে পারে জাহান্নামে। তাই তো কুরআন ও হাদিসে সময়ের পরিচর্যায় স্ববিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তিনিই রাত-দিন, সূর্য-চাঁদকে তোমাদের উপকারে নিয়োজিত করেছেন এবং তারকারাজিও তাঁরই নির্দেশমতো কর্মে নিয়োজিত। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা ইবরাহিম : ৩৩-৩৪)।
সময় অতি দামি : সময় সবকিছুর তুলনায় দামি। এমনকি সময় সোনার চেয়েও দামি। এ কারণেই জীবনের অন্তিম মুহূর্তে এসে মানুষ আফসোস করে, যদি আরেকটুখানি সময় দেওয়া হতো তাকে! এরশাদ হচ্ছে, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ঐশ্বর্য ও সন্তান-সন্তুতি যেন তোমাদের আল্লাহর স্মরণে উদাসীন না করে। যারা উদাসীন হবে, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি, মৃত্যু আসার আগে তোমরা তা হতে ব্যয় করবে। অন্যথায় সে বলবে, হে আমার রব! আমাকে আরও কিছুকালের জন্য অবকাশ দিলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’ (সুরা মুনাফিকুন : ৯-১০)।
যারা সময়ের গুরুত্ব দিয়েছেন, ইতিহাসে তারা স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন। সময়কে কাজে লাগিয়ে তারা জীবনকে দিয়েছেন পূর্ণতা। কালের বাঁধন পেরিয়ে অর্জন করেছেন কালান্তরের অমরত্ব। সময়ের মূল্য দেওয়া মুসলমানদের ঐতিহ্য ও ধর্মীয় কর্তব্য। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা অনুসন্ধানপ্রিয় অথবা যারা কৃতজ্ঞতাপ্রিয়, তাদের জন্য তিনি পরিবর্তনশীলরূপে রাত-দিন সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা ফুরকান : ৬৪)।
সময়কে মূল্যায়ন করে যারা বড় হয়েছেন, তাদের অন্যতম একজন ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)। তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িতকালেও একটি মাসআলা নিয়ে চিন্তারত ছিলেন। আরেকজন হলেন হযরত দাউদ তাঈ (রহ.); যিনি রুটির পরিবর্তে ছাতু খেতেন। কারণ জিজ্ঞেস করা হলে বলতেন, ‘রুটির বদলে ছাতু খেলে ৫০টি আয়াত বেশি তিলাওয়াত করা যায়।’ আরেকজন হলেন বিখ্যাত আরবি ব্যাকরণবিদ খলিল ইবনে আহমদ (রহ.)। তিনি বলতেন, ‘আমার কাছে সবচেয়ে অসহ্যকর লাগে খাওয়া-দাওয়ার সময়টুকু।’ (সাফহাতুম মিন সাবরিল উলামা)।
বর্ণিত আছে, একবার রাসুল (সা.) কে প্রশ্ন করা হলো, ‘সৌভাগ্যবান কারা?’ তিনি বললেন, ‘যারা দীর্ঘায়ু লাভ করে তা নেকআমলের মাধ্যমে অতিবাহিত করেছে।’ পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, ‘দুর্ভাগা কারা?’ তিনি বললেন, ‘যারা দীর্ঘায়ু পেয়ে তা বদআমলে কাটিয়েছে বা আমলহীন অতিবাহিত করেছে।’ (তিরমিযি : ২৩২৯)।
সময় ও জীবন আল্লাহর অমূল্য দান। সময়ের ইতিবাচক ব্যবহারই জীবনের সফলতা। সময়ের অপচয় ও অপব্যবহার জীবনের ব্যর্থতা। সময়ের যথাযথ ব্যবহার না করা বা অপব্যবহার করার জন্য জবাবদিহি করতে হবে আল্লাহর দরবারে। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘শেষ বিচারের দিনে প্রতিটি মানুষ পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া এক কদমও নড়তে পারবে না। তা হলো, তার জীবনকাল কী লক্ষ্যে কাটিয়েছে? যৌবনকাল কী কাজে ব্যয় করেছে? কোন পথে আয় করেছে? কী কাজে ব্যয় করেছে? জ্ঞান অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করেছে কি-না?’ (তিরমিযি : ২৪১৬)।
আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য অসংখ্য নেয়ামত রেখেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সেই নেয়ামতগুলোর অকৃতজ্ঞতায় মত্ত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতগুলোর অপব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্থ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘সময়ের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্থ, কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের ও ধৈর্য্যরে উপদেশ দেয়।’ (সুরা আসর : ১-৩)। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘দুটি নেয়ামত এমন রয়েছে, যে বিষয়ে মানুষ ধোঁকায় থাকে। তা হচ্ছে, সুস্থতা ও অবসর।’ (বুখারি : ৬৪১২)।
সময়ের এত গুরুত্ব হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই এ ব্যাপারে উদাসীন। অথচ পবিত্র কুরআন বলছে, ‘প্রাচুর্য্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখে, যতোক্ষণ না তোমরা সমাধিগুলো দেখতে পাও (তোমাদের মৃত্যু হয়)। এটি কখনও সঙ্গত নয়; অচিরেই তোমরা জানতে পারবে। আবারও বলি, এটি মোটেই সমীচীন নয়; তা তোমরা অনতিবিলম্বে জানতে পারবে। না, তোমাদের নিশ্চিত জ্ঞান থাকলে অবশ্যই তোমরা মোহগ্রস্থ হতে না। তোমরা (সময়ের প্রতি উদাসীন ও কর্মে অবহেলাকারীরা) অবশ্যই জাহান্নাম দেখবে (তাতে প্রবেশ করবে)। অবশ্যই তোমরা জাহান্নাম চাক্ষুস দেখে (তাতে প্রবেশ করে তার শাস্তি ভোগ করে) প্রত্যয় লাভ করবে। অতঃপর অবশ্যই সেদিন তোমাদের প্রদত্ত সব নেয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।’ (সুরা তাকাসুর : ১-৮)।
সময়ের অপব্যবহার : আমাদের সমাজে গিবত ও পরনিন্দায় সময় কাটানো, টিভি-মোবাইল দেখে সময় কাটানো, হারাম গান-বাজনায় মত্ত থেকে সময় কাটানো, গল্প-গুজবে সময় কাটানো হরহামেশা ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। অথচ মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার ওপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা নারীদের গান বাজতে থাকবে। আল্লাহতায়ালা তাদের জমিনে ধসিয়ে দেবেন এবং তাদের কিছু লোককে বানর ও শূকরে রূপান্তরিত করবেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪০২০)।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মুমিনরা সফলকাম। যারা খুশু-খুজুর সঙ্গে নামাজ আদায় করে এবং অনর্থক ক্রিয়াকর্ম থেকে বিরত থাকে।’ (সুরা মুমিনুন : ১-৩)। রাসুল (সা.) বর্ণনা করেন, ‘মানুষ যখন অনর্থক বিষয়াদি ত্যাগ করে, তখন তার ইসলাম সৌন্দর্যমন্ডিত হবে।’ (মুয়াত্তায়ে মালেক : ৯৪৮)।
বর্তমানে আমরা সময়ের মূল্য দিই না, সময়ের মূল্য বুঝি না। কিন্তু ইসলামের সব কর্মপদ্ধতিতে সময়ের মূল্য অপরিসীম। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দিলে পৃথিবীর কোনো জীবজন্তুকেই রেহাই দিতেন না; কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাদের অবকাশ দিয়ে থাকেন। তারপর তাদের সময় পূর্ণ হলে তারা জানতে পারবে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি সম্যক দ্রষ্টা।’ (সুরা ফাতির : ৪৫)। জীবন চলার বাঁকে বাঁকে সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ মানুষ ব্যাধি ও জরাগ্রস্থ হয়ে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কাজেই সময় থাকতে এখনই সময় সচেতন হতে হবে। আল্লাহর জিকির ও নেক আমলে সময় দিতে হবে।
বিলাল হোসেন মাহিনী, পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ও প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, অভয়নগর, যশোর।