মোঃ ফিরোজ আহমেদ, পাইকগাছা :
খুলনার পাইকগাছা উপজেলা বিএনপির নেতৃত্বাধীন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর থেকে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে দলটির নেতাকর্মীদের মাঝে। মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে দিবসটি পালনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ্যে বিভেদের জন্ম হয়েছে। কেন্দ্রীয় ও জেলা বিএনপির কর্মসূচির ঘোষণা পর চার গ্ৰপে বিভক্ত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করছেন। যার কারণে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে। আর সেই বিভক্তি কাজে লাগিয়ে হাইব্রিড নেতা কর্মীদের পদতলে পিষ্ট হয়ে হতাশায় ভেঙে পড়ছে দলটির ত্যাগী নেতাকর্মীরা।
এছাড়াও কথা মত নিজ বলয়ে না আসলে নিজ দলের কর্মী- সমর্থকরা প্রতিপক্ষের হামলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আতংক ও অপমানের ভয়ে দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সভা-সমাবেশ অংশগ্রহণ করতে অনিহা প্রকাশ করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একাধিক নেতা কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিগত দিনে পাইকগাছা বিএনপির নেতাকর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সভা-সমাবেশ করতেন। একদিকে ছিলেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান উপজেলা বিএনপির সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির (আংশিক) আহ্বায়ক ডাঃ আব্দুল মজিদ (এমবিবিএস)।
অপরদিকে আরেক অংশের নেতৃত্ব দিতেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক (বহিষ্কৃত) এস এম এনামুল হক। এস এম এনামুল হকের বহিস্কার আদেশ এখনো বহাল রয়েছে। কিন্তু আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদনের পর থেকে ভিতরে ভিতরে গ্রুপিং সৃষ্টি হতে থাকে।
বর্তমান বিএনপির চার গ্ৰপের নেতৃত্বে রয়েছেন, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডাঃ আব্দুল মজিদ, সদস্য সচিব সাবেক প্যানেল মেয়র এসএম ইমদাদুল হক, পৌর বিএনপির সভাপতি আসলাম পারভেজ ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এডভোকেট জিএম আব্দুস সাত্তার। যা প্রকাশ্য রূপ নেয় মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস থেকে। ঐদিন পৃথক পৃথকভাবে পুস্তক অর্পণ করা হয়। এর পর ফুলতলা বিএনপি আহ্বায়ক আবুল বাশারের উপর হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার (৪ এপ্রিল) উপজেলা ও পৌর বিএনপির আংশিক সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির ১৮ জন চার গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ্য আসে।
তৃণমূল বিএনপি নেতা কর্মীরা পছন্দের নেতার সারিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে যোগদানের পরপরই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় দলটি ঘিরে। ঐদিন মিছিল শেষে বাড়িতে যাওয়ার সময় তৃণমূল নেতাকর্মীদের আলাপ করতে শোনা যায়, দল তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা দীর্ঘদিন নির্যাতিত ছিলাম। এখন সবাইকে একসাথে মিছিল মিটিং অংশগ্রহণ তো দুরের কথা নিজ দলের কর্মী- সমর্থকরা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির ইউনিয়ন নেতা জানান, সবাই বিএনপির সমাবেশে যোগদানের জন্য যেতে পারলাম না। একজনের সাথে গেলে বাকি তিনজন বিরাগভাজন হবে। তার চেয়ে ভালো চুপচাপ বসে থাকি। তিনি আরো বলেন, এই বিভেদের ক্ষত চিহ্ন তৃণমূল নেতা কর্মীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে হরিঢালী ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ কাশেম জোয়ার্দার বলেন, বর্তমান আহ্বায়ক সম্মেলন প্রস্তুত কমিটিতে অযোগ্য নেতাদের স্থান দেওয়ার কারণে ও প্রভাব বিস্তার করার জন্য হাইব্রিড নেতাকর্মীদের নিয়ে শোডাউনের মাধ্যমে তাদের নেতৃত্বের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চায়। যার কারণে বিগত দিনে জুলুম নির্যাতন ও রাজপথের ত্যাগী নেতাকর্মীরা রাজনীতি করার আস্তা হারিয়ে ফেলছে। যার কারণে তৈরি হয়েছে একাধিক গ্রুপ। দ্রুত এর সমাধান না হলে দলের চরম বিপর্যয় নেমে আসবে।
লতা ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি মোঃ ইব্রাহীম গাজী বলেন, উপজেলা নেতাদের একাধিক গ্রুপের বিভক্তিতে কারণে পাড়া মহল্লায় এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, অনতিবিলম্বে সবাইকে বিএনপির মধ্যে বিভেদ ভুলে একসাথে কাজ করার পাশাপাশি দ্রুত ১০ টি ইউনিয়নের কমিটি গঠনের দাবি জানান তিনি।
পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব এসএম ইমদাদুল হক বলেন, বিতর্কিতদের কমিটিতে স্থান দেওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সমস্যা নিরসনে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডাঃ আব্দুল মজিদকে বারংবার বলেছি সভা ডেকে এই পরিস্থিতির সমাধান করতে। কিন্তু এখনো তিনি করেনি। তিনি জেলা নেতৃবৃন্দের কাছে দ্রুত উপজেলা বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্ব সমাধানের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
উপজেলা বিএনপির সাবেক সাবেক সিনিয়র সহ সভাপতি ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক মোঃ আসলাম পারভেজ বলেন, পৌরসভা বিএনপির কোন্দল নিরসনের পথে। আমরা এক হয়ে কাজ করবো। উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডাঃ আব্দুল মজিদ বলেন, সম্মেলন প্রস্তুত কমিটিতে সিনিয়র নেতাদের অবমূল্যায়নের কারণেই এই গ্রুপিং এর সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দকে জানানো হয়েছে এটার সমস্যা নিরসনে। জেলা নেতৃবৃন্দের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করে তিনি আরো বলেন, আগে কোন বিভেদ ছিল না। আহ্বায়ক কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়নের পাশাপাশি জুনিয়রদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যার কারণে ভিতরে ভিতরে অসন্তোষ থেকে গ্ৰপিংয়ের জন্ম।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোঃ মনিরুজ্জামান মন্টু বলেন, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলার বিএনপির সাংগঠনিক টিমের দায়িত্ব নিয়োজিত রয়েছেন, জেলা বিএনপি’র যুগ্ম-আহবায়ক মোল্যা খায়রুল ইসলাম ও এনামুল হক সজল। দুই জন দুটি উপজেলার নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে বিস্তারিত জানাবেন। তিনি আরো বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ দিয়েছেন, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেউ না চললে ও বিভেদ সৃষ্টি করলে তাদের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সাংগঠনিক ব্যাবস্থা নেওয়া হবে। অচিরেই এই সমস্যা সমাধান হবে বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পাইকগাছা উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপি আয়োজিত বিএনপি’র কর্মী সভায় জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোঃ মনিরুজ্জামান মন্টু পাইকগাছা উপজেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করার ঘোষণা দেন। এরপর গত ১৪ মার্চ জেলা বিএনপির আহবায়ক মনিরুজ্জামান মন্টু ও সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক এডভোকেট মোমরেজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেন।
