
মুহম্মদ আজিজুল হক, চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত :
ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হতে পারাটা আমার জন্য ছিল একটি অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। তার পূর্বে পড়াশোনায় আমি মোটেই মনোযোগী ও যত্নশীল ছিলাম না। ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হবার পর আমি পড়ালেখা করার গুরুত্ব উপলব্ধি করি এবং পড়ালেখার প্রতি ধীরে ধীরে অভিনিবিষ্ট ও যত্নশীল হয়ে উঠি। পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করার একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষাও জন্মলাভ করে অন্তরে। অষ্টম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে ওঠার সময় হলে কলেজের অধ্যক্ষ সাহেব আমাদের ক্লাসের সকল ক্যাডেটের পিতামাতা বা অভিভাবকের নিকট পত্র মারফত জানিয়ে দিলেন তার ছেলের কোন গ্রুপ নিয়ে পড়া উচিত বলে কলেজ মনে করে। চিঠিটি যখন আমার বাবার হস্তগত হলো তখন আমি অষ্টম শ্রেণির শেষ টার্ম-এন্ডের ছুটিতে বাড়িতেই ছিলাম। বাবা বললেন, “কলেজ তোমাকে Science Group নেবার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু তুমি ডাক্তার বা ইঞ্জিনীয়র হও তা তো আমি চাই না। তোমার ছোট ভাইবোনেরা ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়র হবে, ইনশাআল্লাহ। তোমাকে হতে হবে হয় একজন CSP officer নতুবা একজন barrister । সুতরাং, তোমাকে পড়তে হবে Humaniities Group-এ।” আমি বেঁকে বসে বললাম, “না আমি Humanities Group-এ পড়বো না।” বাবা কারণ জিজ্ঞেস করায় বললাম, “লোকে Humanities Group-এর ছাত্রদের খাটো কোরে দ্যাখে। তাদেরকে খুব ভালো ছাত্র মনে করে না। সে কারণেই আমি Humanities Group-এ যাবো না। আপনার সন্তুষ্টির জন্য আমি না হয় ইউনিভার্সিটিতে যখন যাবো তখন Arts Faculty-তে ভর্তি হবো।” আব্বা আমার কথা মেনে নিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন আমার ডাক্তারি পড়বার দিকে একটা ঝোঁক আছে। পাছে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর আমি সেদিকেই ঝুঁকে পড়ি, সেই ভয়ে তিনি বললেন, “ঠিক আছে, তুমি Science Group নিতে পারো, কিন্তু তোমাকে Biology-র পরিবর্তে Geography নিতে হবে।” অবশেষে তাই হলো। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমার বাবা কলেজের চিঠির জবাবে লিখলেন যে আমি Science Group-ই নেবো, কিন্তু আমাকে যেন Biology-এর পরিবর্তে Geography দেয়া হয়। আব্বার এমন সিদ্ধান্তের কথা জেনে আমার এক দূর সম্পর্কের কাকা যিনি ক্যাডেট কলেজে আমাদেরই একজন শিক্ষক ছিলেন, হায় হায় কোরে উঠে আব্বাকে বললেন, “আমার ছেলেকে আমি চেষ্টা কোরেও Science Group-এ দিতে পারলাম না। আর তোমার ছেলে Science Group পাওয়া সত্ত্বেও তাকে Biology নিয়ে পড়তে দিলে না। ওতো ভালো ছাত্র। ভবিষ্যতে ও ডাক্তার হতে পারতো।” কিন্তু এই মন্তব্যে আব্বার অভিমত এতটুকু নড়বড়ে হলো না।
নবম শ্রেণি থেকে Science Group নিয়ে পড়াশোনা করা শুরু হলো। General Mathematics-এর সাথে যুক্ত হলো Elective Mathematics। General Science-এর স্থলাভিষিক্ত হলো Physics এবং Chemistry। নবম ও দশম শ্রেণির Physics এবং Chemistry আমার মনে তেমন একটা বিরাগ সৃষ্টি না কোরলেও Elective Math-এ আমার অরুচির সূত্রপাত হলো। সেই অরুচি ক্রমশঃ পরিব্যাপ্ত হলো Physics এবং Chemistry-তেও। আমি ধীরে ধীরে সংশয়াচ্ছন্ন হতে লাগলাম Science Group-এ আমার উপযুক্ততা নিয়ে। তখন মনে হলো আমার বাবার সিদ্ধান্তটিই মেনে নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তখন আর পিছু হটার সুযোগ ছিল না; যদিও ভালো লাগতো না বিজ্ঞানের বিষয়গুলো। ভীষণ নীরস ও বিস্বাদ মনে হতে লাগলো ওগুলোকে। মনে হলো আমি সায়েন্স গ্রুপ নিয়ে যেন একটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি; সম্মুখে অদূরে শত্রুসেনারা। ভয় পেয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন কোরলেই ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। তাই মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলাম যে যতই ভয়ের কারণ হোক সমরে আমাকে এগোতেই হবে। এটি স্বীকার কোরতে আমার দ্বিধা নেই যে ক্যাডেট কলেজে যাবার পর ছাত্র হিসেবে আমি খুব উচ্চাকাংখী হয়ে উঠি। কিন্তু আমার নিকট এটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে বিজ্ঞান গ্রুপে পড়াশোনা কোরে আমি আমার কাংখিত ফলাফল অর্জন কোরতে পারবো না। উল্লেখ্য, আমাদের ক্লাসের যেসব ছাত্র বাংলা ও ইংরেজীতে অন্যান্য সবার চেয়ে বেশি মার্কস পেত আমি সর্বদাই তাদের একজন ছিলাম। এমনকি, আমার বাবার পরামর্শ অনুযায়ী কলেজ যে আমাকে বায়োলজির পরিবর্তে জিওগ্রাফি দিয়েছিল, সেই জিওগ্রাফিতেও আমি খুব হাই মার্কস পেতাম। ইন্টারমেডিয়েটে বোর্ডে এ সাবজেক্টে রেকর্ড মার্কস পেয়েছিলাম। কিন্তু ইলেক্টিভ ম্যাথ, ফিজিকস, ও কেমিষ্ট্রিতে আমি কুলিয়ে উঠতে পারতাম না। এই সাবজেক্টগুলোই আমাকে পেছনে টেনে রাখতো। নিজের কাছে আমি যেন এক পরাজিত সৈনিক হয়ে গেলাম। মনে খুব কষ্ট অনুভব কোরতাম। অথচ, আমার আব্বা্র নিকট আমি আমার এই কষ্টের কথা ব্যক্ত কোরতে পারতাম না, তাঁর কথামতো হিউম্যানিটিজ গ্রুপে না যাবার কারণে।
উল্লেখযোগ্য যে আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় বিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয়সম্পন্ন, এবং নির্ভীক চরিত্রের একজন মানুষ। তার নির্ভীকতার অবিশ্বাস্য কাহিনী আছে। শারীরিকভাবেও তিনি ছিলেন শক্তিশালী। শারীরিক এবং সাহসিকতার বিচারে আমি ছিলাম আমার মা’র কাছাকাছি; বাবার থেকে অনেকখানি দূরে। এ নিয়ে আমার বাবার একটু দুঃখবোধও ছিল। তাঁর এগারোটি ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমার বাবার প্রত্যাশা ছিল আকাশস্পর্শী। আমি ছিলাম ভাইবোনদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে, এবং ভাইদের মধ্যে বড়। ওপরে যেমনটি বলেছি, আব্বা চাইতেন তাঁর বড়ছেলে হিসেবে আমি হয় একজন ব্যারিস্টার নতুবা একজন CSP অফিসার হই। তাঁর ইচ্ছে ছিল আমার অন্যান্য ভাইবোনেরা ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়র, আইনজীবি এবং অন্যান্য পেশায় থাকবে। আল্লাহর অসীম রহমতে তাঁর সেসব ইচ্ছে আল্লাহতায়ালা পূর্ণ কোরেছিলেন। আমরা তিন ভাই ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলাম। আমাদের পরে আমার আপন দুই মামাতো ভাইও ঐ কলেজে শিক্ষার্থী ছিল। তারা কর্মজীবনে একজন সামরিক অফিসার এবং অপরজন স্থপতি হয়েছে। আমার নিজের ভাইবোনদের মধ্যে একজন ইঞ্জি্নীয়র, একজন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সিনিয়র অফিসার, দু’জন আইনজীবি (বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও ঢাকা জাজ কোর্টে), এবং একজন সিনিয়র ব্যাংকার রয়েছে। আমার চতুর্থ ভাইটি ছিল ডাক্তার। MBBS পাশ কোরবার বছরখানেক পরেই সে আপনজনদের অধিকাংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও South Africa-য় চলে যায় চাকরির সন্ধানে; এবং সে দেশে ডাক্তার হিসেবে প্রাকটিস কোরবার লাইসেন্সপ্রাপ্তির জন্য আরো প্রায় দু’বছর পড়ালেখা কোরে সাউথ আফ্রিকার Eastern Cape Province-এর East London শহরের একটি হাসপাতালে Medical Officer হিসেবে চাকরি লাভ করে। মাত্র বছরদেড়েক চাকরি কোরবার পর তার হাসপাতালের বার্ষিক পিকনিক শেষে নিজের গাড়ি চালিয়ে ফেরার পথে পার্বত্য এলাকায় গাড়ি এ্যাকসিডেন্ট কোরে ঘটনাস্থলেই সে প্রাণ হারায়। দিনটি ছিল ৮ই ডিসেম্বর ১৯৯৫। তখনো সে অবিবাহিত ছিল। জানুয়ারীতে দেশে এসে বিয়ে কোরে পুনরায় ওদেশে ফেরার কথা ছিল। হায়রে আমার হতভাগা ভাই! ওদেশে যাবার বস্তুত তার কোনোই প্রয়োজন ছিল না। ডাক্তার হিসেবে অত্যন্ত স্বল্প সময়ে দেশে খুব হাতযশ অর্জন করছিল সে। খিলগাঁওয়ে সে নিজেই একটি ফার্মেসী খুলেছিল যেখানে সে বসতো। লোকে বলে, যার যেখানে মৃত্যু লেখা সে সেখানে যায়। মৃত্যুই তাকে সেদেশে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
যাহোক, আমার নিজের পড়ালেখার কথায় ফেরা যাক। ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে এসে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন কোরে চরম অস্থিরতা দেখা দিতে শুরু করে। পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে গণমানুষের অসন্তোষ ১৯৬৯-এ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আমরা তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। উল্লেখ্য, ক্যাডেট কলেজগুলিকে ছাত্র-রাজনীতি মুক্ত রাখা হয়েছিল। তখনকার দিনে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র চারটি ক্যাডেট কলেজ ছিল। সেগুলি ছিল ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ, ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজ এবং রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ। ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজের প্রকৃ্ত অবস্থান ছিল তখনকার দিনের ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহকুমার মির্জাপুরে। উল্লেখযোগ্য যে স্বাধীনতার বেশ পরে ময়মনসিংহে মেয়েদের জন্য একটি ক্যাডেট কলেজ স্থাপিত হলে মির্জাপুরে অবস্থিত কলেজটিকে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ নামকরণ করা হয়। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধিকার ও স্বায়ত্ব শাসনের জন্য এ প্রদেশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাথে ক্যাডেট কলেজের ছাত্রদের একাত্মবোধ ছিল, কিন্তু সক্রিয়ভাবে সেই আন্দোলনে যোগদানের সুযোগ তদের ছিল না।
এখানে উল্লেখ্যযোগ্য যে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার একটি ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁকে সামরিক বিধির আওতায় গ্রেফতার কোরে এ সংক্রান্ত একটি মামলা দায়ের করে। এটি ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রবল জোয়ারের মুখে পাকিস্তান সরকার ঐ মামলা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ঐ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ আগরতলা মামলার অন্যান্য আসামীদেরকেও মুক্তি দেয়া হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের জন্য আয়োজিত এক সংবর্ধনায় উপস্থিত ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের মহানয়ায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। যাহোক, পাকিস্তানের উভয় উইং-এ আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন তীব্রভাবে চলতে থাকে। ফলে, ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়া খান সংবিধান রহিত করেন এবং সারাদেশে মার্শাল ল জারি করেন। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইয়াহিয়া খানের সরকার ভাবতেই পারে নি যে সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ২টি ছাড়া সবগুলোতেই জয়লাভ কোরবে। উল্লেখ্য যে, পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪৮টি আসনের মধ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি পেয়েছিল ৮৮টি আসন। দু’জনের কেউই অপরের অংশে (অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানে এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে) একটি আসনও পান নি।
সমগ্র পাকিস্তানে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও সামরিক জান্তা নানা অজুহাতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন কয়েকবার পিছিয়ে দেয় এবং ১৯৭১ সালের ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন; কোন তারিখে তা বসতে পারে তার উল্লেখ না কোরেই। প্রকৃ্তপক্ষে, পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা কখনোই চান নি যে কোন বাঙালি পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়ক হোন। এই প্রেক্ষাপটেই বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দেন এবং ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। তিনি নির্দেশ দেন যে কোর্ট-কাচারি, আদালত, সেক্রেটারিয়েট, আধা-সরকারি দপ্তর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সবকিছু অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। প্রকৃতপক্ষে, ৮ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুই ছিলেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল প্রদেশের অঘোষিত রাষ্ট্রপ্রধানের ভূমিকায়।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশানুযায়ী ২ মার্চ ১৯৭১ তারিখ থেকেই অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমরা, অর্থাৎ ক্যাডেটরা, সেই অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেই। পরদিন (৩ মার্চ) মাইল দেড়েক দূরের ঝিনাইদহ শহর থেকে কয়েক শত ছাত্র এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ক্যাডেট কলেজে আসে। আমরা (সকল ক্যাডেটরা) ও আমাদের অধ্যক্ষ লে. কর্নেল মঞ্জুরুর রহমান এবং শিক্ষকরা আগত নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রদের সাথে প্রসেশন কোরে ঝিনাইদহ শহরে যাই। ৯ মার্চ তারিখে ক্যাডেট কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ক্যাডেটরা নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে কলেজ ক্যাম্পাস ত্যাগ করে।
আমি চলে গেলাম ফরিদপুরে। আমাদের দেশের বাড়ি তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলা) গোপীনাথপুর গ্রামে হলেও ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে আমার বাবা আমাদের পড়ালেখার সুবিধার্থে বাসা বাড়ি কোরেছিলেন ফরিদপুর জেলা শহরে। ২৫ মার্চ ১৯৭১ তারিখ রাতে পাক সেনাবাহিনী কামান ও ট্যাংক বহর নিয়ে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙ্গালি জাতির ওপর। রাতের আঁধারে ঢাকায় তারা হত্যা করে হাজার হাজার মানুষ। লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢাকা থেকে পালাতে শুরু করে। আমার বাবা আমাকে ছাড়া পরিবারের অন্যান্য সবাইকে গোপালগঞ্জে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। ফরিদপুরের বাসায় থাকলাম শুধু আমার বাবা ও আমি। পাক সেনারাও পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন শহর-বন্দরে ছড়িয়ে পড়ে। যদ্দুর মনে পড়ে, এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে তারা পথে পথে ত্রাস সৃষ্টি কোরতে কোরতে ফরিদপুর শহরে এসে পড়ে। আমরা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে গিয়ে ফরিদপুর শহরের অদূরে বাখুণ্ডায় আমার বাবার এক কলিগের গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিই। পাক সেনারা ফরিদপুর শহরকে পুরোপুরি দখলে নেবার কয়েকটি দিন পর গোপালগঞ্জ, মাদারিপুর, ও বরিশালের দিকে অগ্রসর হয়। এদিকে, ফরিদপুর শহরে এক ধরনের অস্বস্তিকর শান্ত অবস্থা বিরাজ কোরতে শুরু করে। আমার বাবাও আমি ফরিদপুরের বাসায় ফিরে গিয়ে দেখি আমাদের বাসার কিছু কিছু মালপত্র লুট হয়ে গিয়েছে। সেসবের মধ্যে আমার বাবার বিএসএ সাইকেলটিও গেছে। কিছদিনের মধ্যে শহরে অবস্থান কোরছে এমন সকল যুবক-কিশোরদের একটি তালিকাও পাকসেনারা কোরে ফেলে। ফরিদপুর শহরে তখন আমরা ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের তিন ক্লাসমেট ছিলাম। ফারুক হোসেন, আখতার হাসান ও আমি। আমরা চিহ্নিত হলাম।
কিছুকাল পরেই ঘোষিত হলো যে আগষ্ট (১৯৭১) মাসে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। জানানো হলো যে, সকল ক্যাডেট কলেজগুলির এসএসসি পরীক্ষার্থীদেরকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে অবস্থিত ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজে যেতে হবে। সেখানেই তাদের এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আমার দুই ক্লাসমেটদের ও আমার প্যারেন্টসদেরকে জানানো হলো যে আমাদেরকে পরীক্ষা দিতে না পাঠালে তাদের বিরুদ্ধে কঠিন এ্যাকশন নেয়া হবে এবং কলেজ সেসময় পর্যন্ত আমাদের পেছনে যত টাকা ব্যয় কোরেছে তা সব ফেরত দিতে হবে। জানালো যে তারা আমাদের ওপর নজর রাখবে।
আগষ্ট মাসে আমরা পরীক্ষা দিতে ঢাকা হয়ে মির্জাপুর গেলাম। পাকসেনাদের নানাবিধ দুর্ব্যবহারের মাঝে আমাদের এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো। যথাসময়ে ফলাফল প্রকাশিত হলো। তখনকার দিনে পত্রিকাগুলিতে সবার রেজাল্টের পাশাপাশি সব গ্রুপ মিলিয়ে প্রথম বিশজনের কম্বাইন্ড মেরিট লিষ্ট ভিন্নভাবে প্রকাশিত হতো। সেই মেরিট লিষ্টে আমার পজিশন ছিলো ১৮তম। কম্বাইন্ড লিষ্টের বিশজনের মধ্যে ১ম, ৪র্থ, ৬ষ্ঠ, ৮ম, ১০ম, ১৫তম, ১৮তম এবং ১৯তম- এই আটজনই ছিলো আমাদের কলেজ থেকে। তারা ছিল যথাক্রমে মোঃ মোনজুর আলম, মোঃ সাইফুল ইসলাম, এ এস এম ফিরোজ, এস এইচ সেলিম, মোঃ নজরুল ইসলাম, সাইয়েদ সানাউল হক যাইদী, মোঃ আজিজুল হক ও মিজানুর রহমান খান। বাকিরা ছিল যশোর বোর্ডের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। তখনকার দিনে কেউ কোনো সাবজেক্টে ৮০ বা তার ওপরে নম্বর পেলে সেটিকে ‘লেটার মার্কস’ বলা হতো। রেজাল্টের পাশে কে কোন কোন বিষয়ে লেটার মার্কস পেলো সংক্ষেপে তার উল্লেখ থাকতো। আমি লেটার মার্কস পেয়েছিলাম তিনটি বিষয়ে – ফিজিক্স, জিওগ্রাফী, এবং রিলিজিয়াস স্টাডিজে। কেমিষ্ট্রিতে পেয়েছিলাম ৭৮, অর্থাৎ ২ নম্বরের জন্য কেমিষ্ট্রিতে লেটার পাই নি। ইংরেজী ফার্ষ্ট পেপারে পেয়েছিলাম ৭০ সেকেন্ড পেপারে ৭৪ এবং বাংলা প্রথম পত্রে ছিল ৬৫ আর দ্বিতীয় পত্রে ৭১। অংকে খুবই খারাপ কোরেছিলাম; জেনারেল ম্যাথে মাত্র ৬৬ এবং ইলেকটিভ ম্যাথে ৫৮। সর্বমোট প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৭৫০।