নিজস্ব প্রতিবেদক : রেলওয়ের পাহাড়তলী কার্যালয়ের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক; বর্তমানে পরিচালক (ইনভেনটরি কন্ট্রোল) ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিওএস) প্রকৌশলী মো. আনোয়ারুল ইসলাম। নিজেকে পরিচয় দিতেন পতিত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সূজনের ভাগ্নি জামাই। সেই প্রভাব খাটিয়ে আখের গুছিয়েছেন এবং একই সময়ে দুই থেকে তিনটি লোভনীয় পদ আকড়ে ছিলেন। অবৈধ ঘুষ লেদনদেন করতে একই অফিসে চাকরি করা তার শ্যালক হৃদয়ের মাধ্যমে।
অত্যন্ত ধূর্ত এবং দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তা সিসিএস হওয়ার জন্য এখন উঠেপড়ে লেগেছেন। এজন্য খরচ করছেন মোটা অংকের টাকা। আওয়ামী লীগের দোসর একজন কর্মকর্তা এখনো লোভনীয় দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদ আঁকড়ে থাকায় বিস্মিত রেল সংশ্লিষ্টরা। তাকে দ্রুত বদলির জোর দাবি জানিয়েছেন বৈশম্য বিরোধীরা।
জানা গেছে, সিসিএসের মাধ্যমেই পুরো রেলের বিভিন্ন রকম প্রায় ২৫ হাজার ধরনের সরঞ্জাম কেনাকাটা হয়। অতিরিক্ত সিসিএস থাকার সময় নিজের ইচ্ছে মাফিক দর বানিয়ে পণ্য কিনেছেন নিজের দুই ভাগ্নে তূর্য-তন্ময়, তারেক, হাসিনুরসহ কয়েকজনের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ঘুষের বদলে অংশিদার হতেন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের। ওই দপ্তরটির অতিরিক্ত প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক থেকে হয়ে যান ইনভেন্ট্রি কন্ট্রোলের পরিচালক; পরে বাগিয়ে নেন কেনাকাটার গুরুত্বপূর্ণ পদ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিওএস)। কেনাকাটার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে থেকে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
জানা গেছে, অতীতে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে দুদকে। কেনাকাটায় অর্থ ব্যয়ে আছে অসেত অডিট আপত্তি। সর্বশেষ গত ২৮ সেপ্টেম্বর দুদক প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আহসানুল কবির পলাশ বাদি হয়ে করা মামলায় প্রধান আসামি আনোয়ার হোসেন। মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁরা মালামালের পরিমাণ ও কাগজপত্র পরিবর্তন করে মামলাল ক্রয়ের ভুয়া রেকর্ডপত্র তৈরি করে সরকারের বিপুল টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
অভিযোগ ওঠেছে রেলে কেনাকাটার প্রধান পদে (সিসিএস) ফিরতে মরিয়া দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তা নানাভাবে জোর চেষ্টা তদবির চালাচ্ছেন। অবশ্য প্রকাশ্যে সবাইকে বলে বেড়ান এই পদে যাওয়ার আগ্রহ নেই তার। বাস্তবে পদটি পেতে নানা কূটচালে ব্যস্ত। অসৎ এই কর্মকর্তা সিসিএসের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসলে রেলের অফিসের টেবিল-চেয়ারও বিক্রি করে বলে দেবে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ তাঁর দুর্নীতির ব্যাপকতা বুঝাতে তারা এমন মন্তব্য করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আনোয়ার তার দুইজন ভাগিনাকে দিয়ে নিজেই রেলওয়েতে গোপনে ব্যবসা করতেন। আনোয়ারের বড় ভাগিনা তূর্য ও ছোট ভাগিনা তন্ময়। বড় ভাগিনার মালিকানাধীন ‘তূর্য এন্টারপ্রাইজের’ নামে ব্যবসা করতেন। প্রতিষ্ঠান ভাগিনার নামে হলেও সককিছু করতেন আনোয়ার। তাদের মাধ্যমে কাজ করার ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় পরে সেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। এরপর তারেক খন্দকারের প্রতিষ্ঠান ‘খন্দকার এন্টারপ্রাইজের’ মাধ্যমে কাজ করেছে। টাঙ্গাইলের ছেলে তারেকের নামে প্রতিষ্ঠান হলেও কাজ করেছেন আনোয়ার। সেই সুবাদে তারেক আবার আনোয়ারের কাজের পাশাপাশি নিজেও পৃথকভাবে কাজ করতো। তাদের প্রতিষ্ঠানের কাজের তালিকা যাচাই করলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। সূত্র বলছে, তারেক যে যেসব কাজ করে সে পরিমাণ অর্থের যোগান তার কাছে থাকার কথা নয়। তাকে পূঁজি দিচ্ছে আনোয়ার। এরপর নুরুল ইসলাম সূজন মন্ত্রী হওয়ার পর মন্ত্রীর ঘনিষ্ট মো. হাসিনুর রহমানের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ করতো। এসব কাজের টাকা সংগ্রহ করতেন এমএলএসএস থেকে সিসিএস অফিসের অফিস সহকারী পদে আসা আনোয়ারের শ্যালক হৃদয়।
সূত্র জানায়, সাধারণ ঠিকাদারদের চোখ ফাঁকি দিতে বিভিন্ন ধরনের লোকের মাধ্যমে নিজের কাজগুলো করতেন ধূর্ত আনোয়ার। এক সময় চায়ের দোকানে কাজ করা যুবলীগ নামধারী শামসুল আলমকে ব্যবহার করেছেন। এস এ এন্টারপ্রাইজের মালিক হলেও শামসুল আলম বাটালি অ্যাসোসিয়েটস ও অর্ণব এন্টারপ্রাইজের নামে কাজ করতেন। আলম নিজেকে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারি পরিচয় দিতেন। ফলে তাঁর সঙ্গে সখ্য রেখে কৌশলে নিজেই কাজ করতেন আনোয়ার।
সূত্র বলছে, প্রায় দেড় যুগ ধরে চট্টগ্রামে থেকে কেনাকাটার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতেই কাজ করেছেন আনোয়ার। গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। অবশ্য তিনি নিজেকে একজন প্রকৃত দেশ প্রেমিক ও সৎ কর্মকর্তা হিসাবে জাহির করেন। বাস্তবে তার মতো ধূর্ত কর্মকর্তা রেল অঙ্গনে নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তিনি যে অফিসেই গিয়েছেন, সেটা নিজের কব্জায় নিয়ে একক আধিপত্য বিস্তার করেছেন। তার কথার বাইরে কেউ কোন কাজ করতে পারে না।
সূত্র বলছে, আওয়ামী ঘরানার ও তাবাসসুম সিন্ডিকেটের একজন প্রভাবশালী সদস্য এবং সরঞ্জাম বিভাগের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় লুটেরা আনোয়ারুল ইসলাম। সাবেক রেলমন্ত্রী সুজনের ভাগ্নি জামাই পরিচয় দিতেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার দিনে আনোয়ার চট্টগ্রামে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে কয়েকমণ মিষ্টি বিতরণ করেন। সেই সুবাদেই আনোয়ার সবসময় একই সাথে ২/৩ টা পদের দায়িত্ব পালন করতেন। বর্তমানে পরিচালক ইনভেন্ট্রি কন্ট্রোলের পাশাপাশি সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের/পূর্ব দায়িত্বে আছেন। দীর্ঘ সময়ে ২/৩ টা পদে থেকে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন।
আনোয়ার হোসেন রেলের সরঞ্জাম ক্রয়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে সরবরাহকারীরা বলেন, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সরঞ্জাম ক্রয় বিভাগে আছেন। ডিআইসিসি শাখার প্রধান কর্মকর্তাও তিনি। করোনাকালীন সময়ে করোনা উপকরণ ক্রয়ে তিনি কোটি টাকা হাতিয়েছেন। এ বিষয়েও দুদকের মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত হওয়ার পর অ্যাডিশনাল সরঞ্জাম ক্রয় কর্মকর্তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
বর্তমানে পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক এবং আইসিসি পরিচালক হলেও সারাদেশ থেকে পাহাড়তলী ও সৈয়দপুর ডিপো, ওয়ার্কশপ থেকে এসআর, বিভিন্ন কনজুমার থেকে ডিমান্ড বা ইনডেন্ট আসে অনলাইনে। কিন্তু ঠিকাদার তাঁর সঙ্গে দেখা করে ৩ থেকে ৫ পার্সেন্ট ঘুষ দিলেই ইনডেন্ট ছাড় দেন। এভাবে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে নিয়মিত টাকা আদায় করছে। এখন সিসিএস হওয়ার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে খরচ করছেন সেই টাকা।