ইতিহাসের ক্রান্তিকালের এক মহানায়ক ফিদেল কাস্ত্রো মারা গেছেন ৯০ বছর বয়সে। তাকে বলা হতো বিশ্বের প্রবীণতম বিপ্লবী নেতা। বাংলাদেশেও অনুরূপ বা একটু বেশি বয়সের এক জননেতা এখনও বেঁচে আছেন, যাকে আমরা প্রায় বিস্মৃতির অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছি। অথচ তিনি বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার মতো নেতা নন। নবতিপর বয়সেও তিনি তার দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির এখনও নেতা। এখনও দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন এবং এ সম্পর্কে নিজের মতামত সত্যদর্শীর মতো ব্যক্ত করেন।
এই নেতা অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ। বঙ্গবন্ধুর সমবয়সী এই নেতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরও অন্যতম অগ্রনায়ক। সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই বেঁচে আছেন। বাংলাদেশে তিনিই হয়তো একমাত্র নেতা, যিনি ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় পদের জন্য কখনও আগ্রহ দেখাননি। রাষ্ট্রীয় উচ্চপদও যিনি স্বেচ্ছায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমি যতদূর জানি, আইয়ুব খান থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত অনেকেই তাকে তাদের সরকারে গ্রহণের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছেন, উচ্চপদ গ্রহণেরও অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি প্রতিবার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তার রাজনীতি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কিন্তু তাকে নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তার আদর্শনিষ্ঠা, নীতিনিষ্ঠা এবং নির্লোভ রাজনীতি সম্পর্কে কারও কোনো দ্বিমত নেই। কেউ কেউ বলেন, তার মধ্যে একটা একগুঁয়েমির ভাব আছে। কিন্তু সেই একগুঁয়েমিকে তিনি কখনও নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেননি। দেশের স্বার্থে, রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। তার ফল ভালো-মন্দ যা-ই হোক, তার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। রাজনীতির সুদিনে অথবা দুর্দিনে তার মধ্যে কখনও পলায়নপর মনোবৃত্তি দেখা যায়নি।
তার গত জন্মদিনে তাকে নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল। পেরে উঠিনি। এই সেদিন হঠাৎ শুনতে পেলাম তিনি অসুস্থ এবং হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। মনটা ধক করে উঠল- হায়, তাকে বুঝি জীবিতাবস্থায় আমার শ্রদ্ধা জানাতে পারলাম না। পরে জেনেছি, তিনি সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে এসেছেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি। ভেবেছি, তার পরবর্তী জন্মদিনের জন্য অপেক্ষা করব না। এখনই একটা লেখায় তাকে আমার শ্রদ্ধা জানাব। তার রাজনৈতিক মতামতের সঙ্গে শতভাগ মিল আমার না থাকতে পারে; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাকে আমি একজন মহামহীরুহ মনে করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস যেদিন লেখা হবে, সেদিন সেই ইতিহাসে তার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্থান পাবে।
বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কালচার যারা সচেতনভাবে তৈরি করেছেন, তাদের মধ্যে অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ অবশ্যই একজন। সেই ১৯৫৪ সালে শিক্ষকতার পেশা ত্যাগ করে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পরে অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতান্ত্রিক বাংলা গড়ার রাজনীতিতেই জীবনপাত করেছেন। লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি। যদি কেউ বলেন তিনি লক্ষ্য অর্জনের সফল হননি, তাহলে বলব কথাটা সঠিক নয়। তার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন (পরবর্তীকালে স্বাধীনতা), জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, অপুঁজিবাদী অর্থনীতি, অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তা। এর সবই আওয়ামী লীগের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ন্যাপ অর্জন করেছে। সংবিধানে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে এগুলো স্থান পেয়েছিল। পরবর্তীকালে ক্ষমতার রাজনীতিতে যে ন্যাপ পিছিয়ে গেল তার জন্য মুজাফ্ফর আহমদ দায়ী নন। দায়ী তখনকার বাম রাজনীতি, বিশেষ করে ন্যাপের সহযোগী সিপিবির রাজনীতি।
তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুজাফ্ফর আহমদ একটা কথা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। আওয়ামী লীগ যখন এককভাবে ক্ষমতায় গেছে তখন দেশে একটি সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক শক্তিশালী বিরোধী দলের অস্তিত্ব প্রয়োজন। নইলে বিরোধী দলের শূন্যাবস্থা পূরণ করবে পরাজিত অশুভ শক্তি। এই উপলব্ধি থেকেই কি তিনি ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে ভিয়েতনাম দিবস পালনের নামে সরকারের বিরোধিতায় ন্যাপকে রাজপথে নামিয়েছিলেন এবং নিজে বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এই বিক্ষোভ মিছিল তোপখানা রোডে তৎকালীন মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের সামনে এলে পুলিশ গুলি চালায়। তাতে দু’জন নিহত হয়।
এর পর ন্যাপের সহযোগী দল কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) হঠাৎ নীতি বদলায়। সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা নয়, সহযোগিতা। সরকার যাতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের খপ্পরে পড়ে না যায়, সে জন্য সহযোগিতা দিয়ে তাকে ধরে রাখতে হবে। ন্যাপ নেতা মুজাফ্ফর আহমদ কি তার সহযোগী কমিউনিস্ট দলের এই নীতি সর্বান্তকরণে মেনে নিয়েছিলেন? আমি তা জানি না। এ নিয়ে তার সঙ্গে তখন কোনো আলোচনার সুযোগ আমার হয়নি।
আমার মনে হয়েছে, অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বে ন্যাপ তখন ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল (একমাত্র ভাসানী ছাড়া তার নেতৃত্বাধীন ন্যাপ তখন এতটা শক্তিশালী ছিল না)। সিপিবি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশ্ব রাজনীতির স্বার্থে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের যতই গলগ্রহ হোক, ন্যাপ তার স্বাধীন সত্তা নিয়ে দেশে একটি গণতান্ত্রিক বিরোধী দল গড়ে তুলবে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে দলটির হার হওয়া সত্ত্বেও বিরোধী দলের শূন্যস্থানটি ন্যাপই পূর্ণ করতে পারবে। ন্যাপ তা না করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গণঐক্য জোটে মিলিত হওয়ায় বিরোধী দলের এই শূন্যস্থানটি দখল করে নিয়েছে পরবর্তীকালে ‘ইনকেনটাইল অ্যাডভেঞ্চারিস্ট’ জাসদ এবং ‘৭১-এর পরাজিত রাজনৈতিক অপশক্তি।
আমার ধারণা, মুজাফ্ফর আহমদ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ন্যাপকে একটি গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিরোধী দল হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কমরেড মণি সিংহ-সহ তখনকার কমিউনিস্ট নেতাদের চাপে তিনি তা পারেননি। আমার এ ধারণা সঠিক কি-না তা জানার সুযোগ কখনও হয়নি। এখানে পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর সঙ্গে অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদের একটু তুলনা করি। দিলি্লতে নরসীমা রাওয়ের কংগ্রেস সরকারের পতনের পর বামপন্থি দলগুলোর ভারতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার একটা সুযোগ এক সময় এসেছিল। জ্যোতি বসু তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে বসানোর প্রস্তাব ওঠে। কিন্তু বাগড়া দেয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিউনিস্ট পার্টি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে জ্যোতি বসুর বসার ব্যাপারে তারা অমত প্রকাশ করে। জ্যোতি বসু দলের ইচ্ছা মেনে নিয়েছিলেন। তার পরিণতি, বামপন্থিদের অনৈক্যের সুযোগে সাম্প্রদায়িক দলগুলোর শক্তি সঞ্চয় এবং দিলি্লতে বিজেপির ক্ষমতা লাভ।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সহযোগী কমিউনিস্ট দলের নেতাদের ইচ্ছাতেই কি অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ তার দল ন্যাপ নিয়ে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বিরোধী দল গঠনের ইচ্ছা ত্যাগ করে সর্বকাজে আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দানের নীতি গ্রহণ করেছিলেন? সে কাজটা তখন করেছিল সিপিবি। যার ফল দেশে বিরোধী শক্তি হিসেবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অভ্যুত্থান! সিপিবি ও ন্যাপ যখন সরকারকে সর্বতোভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে, তখন সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য মন্ত্রিসভায় তারা যোগদান করেননি কেন? আমি যতদূর জানি, বঙ্গবন্ধু চাচ্ছিলেন অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিক। তিনি মন্ত্রিত্বের অফার প্রত্যাখ্যান করেন। ক্ষমতার লোভ তাকে কখনও আকৃষ্ট করেনি। কিন্তু প্রয়োজনের সময় তিনি কেন কঠোর হননি, এটাই আমার প্রশ্ন। তার সঙ্গে দেখা হলে এই প্রশ্নগুলোর জবাব তার কাছেই জানতে চাইব_ এই ইচ্ছা আমার ছিল। বিদেশে থাকায় সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি।
অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদকে আমি আরও একটি বড় কারণে শ্রদ্ধা করি। তিনি আমার কলেজ জীবনের শিক্ষক। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় আমি যখন ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, তখন তিনি সেই কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান। আমি অঙ্ক এবং অর্থনীতি দুটি সাবজেক্টকেই ভয়ানক ভয় করে চলতাম। কিন্তু মুজাফ্ফর স্যারের অর্থনীতির ক্লাসে যেতাম পরম আগ্রহের সঙ্গে। তিনি তখন সুদর্শন যুবক। গৌরবর্ণ চেহারা। অর্থনীতির দুরূহ বিষয়ও এমন সরসভাবে পড়াতেন যে, তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারা যেত না। মাঝে মধ্যে তার লেকচারে থাকত এমন হাস্যরস, যা বিষয়টি বোঝা আরও সহজ করে তুলত।
তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, এখনও করেন। বিলাতে বসে বাংলাদেশের কাগজে লিখি। তিনি কয়েক বছর আগেও প্রায়ই টেলিফোনে আমার লেখা সম্পর্কে তার মতামত জানাতেন। বয়সাধিক্যে যখন আর টেলিফোন করতে পারতেন না, তখনও ঢাকায় আমার বন্ধু মোনায়েম সরকারের কাছে আমার খবর নেন। তার পত্নী আমেনা ভাবিও আমাকে টেলিফোন করেন এবং খবর নেন। তাদের কাছ থেকে স্যারের খবরও পাই।
অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ সম্পর্কে আমার ধারণা, তিনি আমাদের ইতিহাসের ক্রান্তিকালের নায়ক। একজন মহানায়ক। তাকে বিস্মৃতির অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া যাবে না। পঞ্চাশের দশকে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জন্ম এবং সেই দলে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণে মুজাফ্ফর আহমদের অসাধারণ দক্ষতা, স্বাধীনতা যুদ্ধে মস্কোর সমর্থন আদায়ে তার কূটনৈতিক সাফল্য, সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যে তার অবিচল নিষ্ঠা ইত্যাদি সম্পর্কে আরও বিশদ আলোচনা দরকার। সময় ও সুযোগ হলে সে আলোচনা করার ইচ্ছা রাখি। আজ শুধু এই বোধিবৃক্ষের মতো প্রবীণ মহানায়ককে আমার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানিয়েই লেখাটি শেষ করছি।
লেখকঃ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।