বিল্লাল মাহিনী॥ পবিত্র কুরআনে ঐক্যবদ্ধ জীবন যাপনের গুরুত্ব বর্ণনা করে বেশ কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। উক্ত আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করা মুসলিম উম্মাহর জন্য ওয়াজিব। মহান আল্লাহ বলেন-
‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু (দ্বীন)কে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর যে নেয়ামত রয়েছে তা স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে তখন তিনিই তোমাদের অন্তঃকরণে (উদারতা) প্রীতি স্থাপন করেছিলেন, তারপরে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে ভ্রাতৃত্বে আবদ্ধ হলে এবং তোমরা অনলকুণ্ডের ধারে ছিলে, অনন্তর তিনিই তোমাদের ওটা হতে উদ্ধার করেছেন; এরূপে আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় নিদর্শনাবলী ব্যক্ত করেন যেন তোমরা সুপথ প্রাপ্ত হও’। (সুরা আলে ইমরানঃ ১০৩)
তিনি আরও বলেন- ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল বা সংঘ থাকা উচিত যারা আহ্বান জানাবে সৎ কর্মের প্রতি, নির্দেশ দিবে ভাল কাজের এবং নিষেধ করবে অন্যায় কাজ থেকে। আর তারাই হ’ল সফলকাম’ (সুরা আলে ইমরানঃ ১০৪)।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন- ‘তোমরাই সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দিবে এবং আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনবে’ (সুরা আলে ইমরানঃ ১১০)।
রাসুল (সা.) ঐক্যবদ্ধ জিন্দেগীর উপর গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে বলেছেন: হযরত উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ: নবী (সা.) বলেছেন, “তোমরা সংঘবদ্ধ হও এবং শতধা-বিভক্ত হয়ো না। কারণ শয়তান একাকীর সাথী হয় এবং দু’জন থেকে অধিক দূরে থাকে। আর যে ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ জান্নাত চায়, সে ব্যক্তির উচিত ঐক্যে শামিল হওয়া।” (কিতাবুস সুন্নাহ, শায়বানী ৮৮)।
নবী সা. আরও বলেন- ‘আমি তোমাদেরকে এমন পাঁচটি কথার হুকুম দিচ্ছি যা আল্লাহ আমাকে হুকুম করেছেন –১. সংগঠনবদ্ধ হওয়া, ২. নেতার কথা শুনা, ৩. আনুগত্য করা, ৪.হিজরত করা ও ৫. আল্লাহর পথে জিহাদ করা।’ (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযি)।
তিনি সা. আরও বলেন- ‘যখন তিন জন লোক সফরে যাও তখন তোমাদের একজনকে আমীর বানাও।’ (আবূ দাউদ ২৬০৮-৯)।
রাসুল সা. বলেন- ‘যে ব্যক্তি ইসলামি সংঘ পরিত্যাগ করল সে ইসলামের শিকল তার গলা থেকে ছুঁড়ে ফেলল।’ (মুসনাদে আহমাদ ও আবূ দাউদ ৪৭৫৮)।
হাদিসে আরও কঠিন করে বলা হয়েছে – “যেই ব্যক্তি ইসলামি সংঘ থেকে বিচ্ছিন্ন (একাকী) অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু।” (মুসলিম ১৮৫১)
এখন কথা হলো, যারা তথাকথিত ইসলামি দল করেন না, তারা কি জাহান্নামি?
উত্তরে বিশ্বের আলেম ওলামা ও মুফতিয়ে কেরাম বলেন, এখানে জামায়াত তথা সংঘ থেকে বিছিন্ন হওয়া বলতে প্রচলিত ইসলামি রাজনৈতিক দল করা বা না করা উদ্দেশ্য নয়। বরং মুসলিম ইমামের অধিনস্ত থাকা উদ্দেশ্য।
তবে মুসলিম জীবনে সংঘবদ্ধ থাকার এ বিরাট গুরুত্বের দরুনই ফরয নামায জামায়াতে আদায় করার জন্য এতো তাগিদ হাদীসে রয়েছে। যারা নামাযের জামায়াতে আসেনা রাসুল (সা.) তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ইচ্ছা পর্যন্ত প্রকাশ করেছেন।
পবিত্র কুরআন, হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামের জীবন একথাই প্রমাণ করে যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করা ওয়াজিব।
একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ও তার সমাধান :
দ্বীন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা ওয়াজিব। তবে এর ব্যাখ্যা ও বোঝার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একদল মনে করেন, ইকামতে দীন বলতে তাওহিদ প্রতিষ্ঠা ও ব্যক্তি কেন্দ্রিক ইসলাহ বুঝায়। আরেক দলের মত হলো- দ্বীন প্রতিষ্ঠার অর্থ হলো, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করা।
তবে, বিশ্ব ইসলামি স্কলার ও ফোকাহায়ে কেরামের মতে দুইটার সমন্বয় হলো ‘ইকামতে দ্বীন’। একটা থেকে আরেকটাকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই।
তাওহিদ ও ব্যক্তি ইসলাহ ছাড়া সামগ্রিক দ্বীন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে তাওহিদের দাবিও পরিপূর্ণভাবে আদায় করা সম্ভব নয়।
এখন, একদল যদি তাওহিদ ও ব্যক্তি ইসলাহের কাজ করেন । আরেকদল যদি তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দীন প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন তাহলে প্রথম দল দ্বিতীয় দলের সম্পূরক এবং সহযোগী। উভয় দলই দ্বীনের দাঈ, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং দু’টাই ইকামতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু তাওহিদের দাওয়াত দিতে গিয়ে কেউ যদি কাউকে বৃহৎ ইসলামি সংগঠনে যোগ দিতে নিষেধ করেন বা এটাকে যথেষ্ট মনে করে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেন তাহলে তিনি মূলত: ইকামতে দ্বীনেরই বিরোধিতা করলেন।
আর একটা কথা, সংঘবদ্ধভাবে কাজ করতে গিয়ে ইসলামে যে বাইয়াত (শপথ) নেওয়া হয় তা সাংগঠনিক শৃঙ্খলার জন্য এবং কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য। শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত বাইয়াত এখানে উদ্দেশ্য নয়। এই বাইয়াতের ব্যাপারে শরিয়তের কোনো হুকমও লাগানো ঠিক হবে না। তাই বাইয়াত ছাড়া মৃত্যুবরণ করলে জাহেলিয়াতি মৃত্যু হবে, এমন কথা সঠিক নয়।
আল্লাহ তায়ালা গোটা মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছেন এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধ করেছেন। (সূরা আল ইমরান-১০৩)
কিন্তু আমরা বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে একদল আরেক দলের বিরুদ্ধে ফাসিকি, নেফাকি, কুফরি, গোমরাহী ইত্যাদি তোকমা লাগিয়ে ফেরকাবন্দি হয়ে পড়ে আছি।
এটা আল্লাহর নির্দেশ বিরোধী। কিন্তু দ্বীন পালনের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে কাজ করা শরিয়তে নিষিদ্ধ নয়। তাই মুসলিমদের যদি এক দল আরেক দলের বিরোধিতা না করে এবং নিজের জাত, গোষ্ঠী ও বংশ আলাদা না করে একে অপরের সম্পূরক, সহযোগী ও ভ্রাতৃত্বসূলভ সম্পর্ক রেখে কাজ করে তাহলে ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়েও মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ থেকে দীন প্রতিষ্ঠার কাজ করতে পারে।
বর্তমান বিশ্বে ঐক্যের ক্ষেত্রে সবচে’ বড় অন্তরায় হলো রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা ও প্রতিহিংসা। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে মুসলিম হিসেবে ঐক্যবদ্ধ থাকার তৌফিক দান করুন। (আমিন)
বিলাল হোসেন মাহিনী, পরীক্ষক: ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ও প্রভাষক, গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাস্টার্স মাদরাসা, অভয়নগর যশোর।