বদলগাছী নওগাঁ প্রতিনিধি॥ নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলায় দিন দিন অপচিকিৎসা ও ভণ্ড কবিরাজদের প্রতারণা বেড়ে চলেছে। ঝাড় ফুঁকের পাশাপাশি, যৌন-উত্তেজক সিরাপ তুলে দিচ্ছে রোগীর হাতে। আবার কেউ গোণা পড়ার নামে মিথ্যা অভিনয় ও কৌশলে সাধারণ মানুষদের কাটছে পকেট। আবার কেউ কেউ এদের থেকেও অনেক উপরে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যে সব রোগীর চিকিৎসা করতে ব্যর্থ সেসব রোগীর পরিবারের মানুষদের বিভিন্ন টোটকা জাদু দেখিয়ে রোগী ভালো করার জন্য বেহুলার গান দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে এক নাইট ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা। সেই সাথে মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করছে এবং মুসলমানদের পূজা করতে বাধ্য করছে সামছুল কবিরাজ। নিজ উপজেলা সহ পার্শ্ববর্তী উপজেলায় প্রতিনিয়তো কোনও না কোন স্থানে রোগী ভাল হওয়ার ফাদেঁ বেহুলার গান চলে ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বদলগাছী উপজেলার মিঠাপুর ইউনিয়নের হাজিপুর গ্রামের মোঃ খলিলুর রহমানের ৩য় পুত্র মোঃ বাধন ওরফে সামসুল হক (৪৮)। একজন কবিরাজ সামসুলের বাসায় সপ্তাহে দুই দিন শনিবার+মঙ্গলবারে অনেক দুর দুরান্ত থেকে রোগী আসে। পাঁচ টাকা হাদিয়ায় রোগীর রোগের বর্ণনা শুনে মোমবাতির আলোতে কাঁচের গ্লাসে পানিতে দেখে বলে তোর রোগের চিকিৎসা আছে। কবিরাজ সামসুল ইসলাম এখনো বিয়ে করেনি, তিনি পরীকে বিয়ে করেছেন। এলাকাবাসী সুত্রে জানা গেছে, তিনি কয়েক বছর আগে মানুষের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বাবা হাটে মানুষের গরু বিক্রি করে বিক্রেতা-ক্রেতা কিছু সহায়তা করতেন, আর ঐ ভাবে তার সংসার চলত।
হঠাৎ পরীর সঙ্গ নিয়ে বড় কবিরাজ বনে যান বড় কবিরাজ। শুরু করে সরলা অবলা মানুষের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা।
খোজ খবর নিয়ে দেখা গেছে তার বাড়িতে নেই কোন ঔষধি গাছ, তবুও তিনি গাছ গাছারী থেকে ঔষধ তৈরী করে সকল রোগের চিকিৎসা প্রদান করে। রোগীর সমস্যা শুনে পানিতে সবকিছু দেখতে পায় এমন অভিনয় আর কৌশল দেখিয়ে মানুষদের বোকা বানিয়ে বেহুলার গান দেওয়ার নামে ৩০, ৫০, ৬০ হাজার টাকা চুক্তির মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে। সে একজন মুসলিম পরিবারের সন্তান হওয়ার পরেও রোগ নির্ণয় করে বলে বেহুলার গান দিলে রোগী ভাল হবে। এবং তিনি নিজেই উক্ত গানে দেবী দূর্গা/মনসা সেজে পূজা গ্রহণ করে, যাহা ইসলাম ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানছে। সর্বরোগ সারানোর কথা বলে ভুয়া কবিরাজ বনে ঝাড়-ফুক, পানিপড়া, তাবিজ-কুফুরী সহ বিভিন্ন গাছ গাছারী দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে লুটে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। আর তাদের এ প্রতারণার কাজে গোপনে সহযোগিতা করছেন স্থানীয় কয়েকজন নেতা ।
ভুয়া কবিরাজ সামসুল ইসলাম বন্ধ্যা নারীদের সন্তান হওয়া, অল্প বয়সে চুল পাকা, প্রতিবন্ধী শিশুদের ভালো করা, প্রেমিক-প্রেমিকাকে পাইয়ে দেওয়া, জিন-ভূত তাড়ানো, যেসব নারীদের বয়স পেরিয়ে গেলেও বিয়ে হচ্ছে না, ক্যান্সার, ডায়াবেটিকস, আমাশয়, গ্যাস্ট্রিক, পিত্তথলিতে পাথর, প্যারালাইসিস, বাতের ব্যথা, হাঁপানি, যৌন সমস্যা সমাধান, সরকারি চাকুরী পাইয়ে দেওয়া, করোনাসহ নানা জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা করে থাকেন। রোগ অনুসারে ২৫০ থেকে ১ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন গ্রামের সহজ সরল মানুষের কাছ থেকে। তিনি বাড়ি তৈরী করেছেন ২০–২৫ লক্ষ টাকা খরচ করে,কিনেছেন আক্কেলপুর উপজেলায় জমি।
সরেজমিনে দেখা যায়, মহাদেবপুর উপজেলার উত্তরগ্রামের সলিম উদ্দীনের ছেলে সোহেল বলেন, আমার গলা চেপে ধরা, মাথা ব্যাথা, হাত-পা চলেনা, সামান্য চলা চল করলে মাথা ঘুরে পড়ে যাই, খাইতে পারিনা এগুলো সমস্যা নিয়ে বড় বড় ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিয়ে ঔষধ খাওয়ার পরও সুস্থ না হলে গ্রামের মানুষের কাছে শুনে বদলগাছী উপজেলার মিঠাপুর ইউপির হাজিপুর গ্রামের সামসুল কবিরাজের কাছে যাই। কবিরাজ পানির গ্লাসে দেখে আমাকে বলে তোর বড় সমস্যা। তোকে মনসা ধরেছে ৫ সপ্তাহ ঔষুধ খা তারপর দেখি। ৫ সপ্তাহ ঔষধ খাওয়ার পর শরীরের কোনও উন্নতি না হলে সে বলে বেহুলার গান দিতে পারবি, গান দিলে ভাল হবি।আমি ভাল হওয়ার জন্য বেহুলার গান দিতে রাজি হই। প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ করে বেহুলার গান দিয়েছি।গান দেওয়ার পরও আমি সুস্থ হয়নি। কবিরাজের কাছে গেলে বলে ডাক্তার দেখায়ে চিকিৎসা নাও। কবিরাজ সামসুলের কথা শুনে আমি নিঃস্ব হয়েছি।
মহাদেবপুর উপজেলা কৃষ্ণপুর গ্রামের রিয়াজ উদ্দীনের ছেলে রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার তিনটা বউ চলে গেছে। তাই আমি সামছুল কবিরাজের কাছে গেলে তিনি বলেন আমার কাছে নাকি মনসা আছে বেহুলার গান দিলে ভাল হবে, বিয়ে করলে বউ বাড়িতে থাকবে।
পত্নীতলা উপজেলার আমাইড় ইউনিয়নের অষ্টমাত্রাই গ্রামের তৈয়ব আলীর স্ত্রী বলেন, আমার স্বামীর হঠাৎ করে মাথার ব্রেনের সমস্যা হলে ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা গ্রহন করে, ভাল না হলে বদলগাছী মিঠাপুরে হাজিপুর গ্রামের বাধন ওরফে সামছুল কবিরাজের কাছে গেলে তিনি পানির গ্লাসে দেখে বলে আমাকে মনসা ধরেছে বেহুলার গান দিলে ভাল হবে। তার সাথে চুক্তি করে বেহুলার গান করি।গান দেওয়ার পরও আমি সুস্থ হয়নি। পরে কবিরাজের কাছে গেলে কবিরাজ বলে মাথার সমস্যা ডাক্তার দেখান। এই ভুয়া কবিরাজের কথা শুনে আমরা নিঃস্ব হয়েছি।
এ ব্যাপারে ভুয়া কবিরাজ সামসুল ইসলামের শিক্ষাবিদ্যা কত দূর জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভাবের কারণে খুব বেশী পড়াশুনা করতে পারিনি।তিনি বলেন, পরী আমাকে বিয়ে করার পর থেকে কয়েক বছর থেকে বাড়িতে সর্বরোগের ঝাড়-ফুক, গাছ-গাছারী আর পানি পড়া, তৈল পড়া দিয়ে মানুষের রোগ ভালো করছি। কবিরাজি সনদ দেখতে চাইলে বলেন, মেম্বার-চেয়ারম্যান মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছেন রোগীর দেখার জন্য। তবে সাধারণ মানুষ এখনো বুঝতে পারেনি সামসুল হক কবিরাজ একজন প্রতারক। প্রতিনিয়তই প্রশাসনের চোখের সামনে এ প্রতারণা কাজ করে কিন্ত তার বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা কানিজ ফারহানা বলেন, আমি বিষয়টি জানতে পেরেছি। আমরা আমাদের মতো করে খোঁজ নিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব যাতে সাধারণ মানুষ কে রক্ষা করা যায়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলপনা ইয়াসমিন বলেন, প্রমান মিললে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।