মোঃ মাহবুবুর রহমান, সিরাজগঞ্জ॥ সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার তাঁতের শাড়ির সুনাম রয়েছে দেশ – বিদেশে। এ উপজেলা তাঁত সমৃদ্ধ এলাকা হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী তাঁতের সুতি শাড়ির পাশাপাশি জামদানি শাড়িও বেশ জনপ্রিয়। দেশের মত বিদেশেও রয়েছে এসব শাড়ির কদর। প্রায় ১০-১৫ বছর বেলকুচিতে ব্যাপকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে একই সুতায় রং-ডিজাইন করে উৎপাদন হচ্ছে এসব শাড়ি। বেলকুচির তাঁত পল্লীগুলো ভোর থেকে রাত পর্যন্ত শ্রমিকরা পাওয়ারলুম, পিটলুম ও হস্ত চালিত তাতে নিখুঁতভাবে তৈরি করছে জামদানি, সুতি কাতান , সুতি জামদানি, সিল্ক শাড়ি, রেশম শাড়ি ও গ্যাস শাড়ি।
এ বিষয়ে উন্নয়ন অনুসন্ধান ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী মো. আব্দুল হাকিম মন্ডল জানান, বেলকুচিতে হস্তচালিত তাঁতসহ বিভিন্ন শ্রেণীর প্রায় ৬০ হাজার তাঁত রয়েছে। এই শিল্পে আট হাজারেরও বেশি তাঁত ফ্যাক্টরির মালিক আছেন। এবং নারী-পুরুষ মিলিয়ে এক থেকে দেড় লাখেরও বেশি শ্রমিক এই পেশার সঙ্গে জড়িত ।
এই শিল্পের একজন শ্রমিক সাধারণত হস্তচালিত তাঁতের একদিনে একটি শাড়ি তৈরি করতে পারেন। আর পাওয়ারলুম একদিনে দুইটি শাড়ি তৈরি করতে পারে। তবে বেশি মাত্রার সূক্ষ্ম কারুকাজ করা শাড়ি তৈরি করতে সময় লাগে বেশি।
শাড়ি তৈরির পর ফুলতোলা বা নকশা কাটার বাড়তি সুতা কাঁচি দিয়ে কেটে চূড়ান্তভাবে নকশা ফুটিয়ে তোলেন মহিলা শ্রমিকরা। একজন পুরুষ শ্রমিক দিনে ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ও নারী শ্রমিক বাড়ির কাজের ফাঁকে ফাঁকে চরকা কাটা ও নকশা কাটার কাজে দিনে ৫০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন।
২ আগষ্ট/২৩ তারিখে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার তামাই, শেরনগর, চন্দনগাঁতী, চালা, মুকুন্দগাতী, সুবর্ণসাড়া, গাড়ামাসী, বেতিল গ্রামের তাঁত কারখানাগুলোর পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করছেন। কেউবা নাটাই ঘুরিয়ে নলিতে সুতা তুলছেন কেউবা কাপড়ের বাড়তি সুতা কেটে দিয়ে গুছিয়ে রাখছেন কেউ আবার প্যাকেট করে বাজারে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করছেন।
এ অঞ্চলের তৈরি শাড়ি দেশের নামিদামি ব্র্যান্ডের শোরুম থেকে শুরু করে স্ট্যান্ডার্ড, আমানত শাহ, আড়ংসহ দেশের বড় বড় কোম্পানিগুলোতে। এসব কোম্পানিগুলো অফ-সিজনে তাদের দেয়া ডিজাইনে তাঁতিদের কাছ থেকে হাজার হাজার পিস শাড়ি কম মূল্যে কিনে মজুদ করে রাখেন। পরে অন-সিজেনের সময় নিজেদের লেবেল লাগিয়ে দ্বিগুণ দামে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাশাপাশি ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে।
এছাড়া, তাঁতিরা তাদের উৎপাদিত পণ্য জেলার শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, সোহাগপুর, সিরাজগঞ্জ নিউমার্কেট, টাঙ্গাইলের করটিয়া কাপড়ের হাটেও বিক্রি করে আসছেন। এসব হাট থেকে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকাররা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁতের শাড়ি।
বেলকুচির পাইকারি বিক্রেতা দাউদ টেক্সটাইলের মালিক সাইফুল ইসলাম ( নুরু ) জানান, দেশের দূর-দূরান্ত থেকে পাইকারি শাড়ি-কাপড় কেনার জন্য নিয়মিত ক্রেতারা এই এলাকায় আসেন। পাশাপাশি অনেক ক্রেতা নিজেরা ব্যবহারের জন্য আমাদের কাছে এসে শাড়ি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের এখানে সীমিত লাভে শাড়ি-কাপড় বিক্রি করা হয়। খুচরার চেয়ে পাইকারি বেশি বিক্রি হয়।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে লুঙ্গি প্রস্তুত করতে যে সুতা ব্যবহার করা হয়, যে রং ব্যবহার করা হয়, তার দাম বৃদ্ধি হওয়ায় অনেক মালিক লুঙ্গি প্রস্তুতের কাজে বাদ দিয়ে শাড়ি-কাপড় প্রস্তুতের জন্য ঝুঁকে পড়েছেন। এতে করে এলাকার লুঙ্গিশিল্প অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেক মালিক তাদের তাঁত বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ, সুতা, রঙ ও শ্রমিকের মজুরি বেশি। যার কারণে প্রতিযোগীতার বাজারে টিকতে না পেরে তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে পারছেন না।
এলাকার সচেতন মহল জানান, প্রাচীনকাল থেকেই তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত বেলকুচিসহ সিরাজগঞ্জের পাঁচটি উপজেলা। একটা সময় এ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটলেও বর্তমানে এই শিল্প অনেকটাই ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। সরকারের দৃষ্টি দিয়ে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা সময়ের দাবি। লাখ লাখ শ্রমিক নিজ এলাকায় কর্মসংস্থান পেয়েছে। যদি এই কর্ম হারিয়ে যায় তাহলে এসব শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। ফলে অর্থনৈতিক অবস্থাও ভেঙ্গে পড়বে। এমতোবস্থায় অতিশীঘ্রই সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।