বিলাল হোসেন মাহিনী : সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। কিন্ত প্রশ্ন হলো, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই বিপ্লবের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে যে ৯ দফা ঘোষণা করা হয়েছিল, তার মধ্যে এটা স্পষ্ট ছিল যে, ফ্যাসিবাদের বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে হবে। সুতরাং হাজারও ছাত্র-জনতার প্রাণ ও ত্যাগের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের বিলোপের পর এখন নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। আর সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা সেটাই করতে চাচ্ছে। কিন্তু একটা বড়ো রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতা সংস্কারে কালক্ষেপণ হচ্ছে এই ঠুনকো অজুহাত তুলে সংস্কারকে বাধাগ্রস্থ করছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। এমনকি সরকারের পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা আক্ষেপ করে বলেছেন, নির্বাচিত সরকারই যদি সংস্কার করবে,তবে বিগত ৫৩ বছরে সংস্কার হয়নি কেন? সময় এসেছে, শুধু গুটিকয়েক খাতা-কলমের সংস্কার নয়, বরং গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তথা রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলে সমন্বিত সংস্কার এখন সময়ের দাবি।
ছোট বেলায় আমরা প্রায়ই সিনেমা বা সিরিয়ালে দেখতাম, এক দল মানুষ গুপ্তধনের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। প্রায় সব সমাজেই গুপ্তধনের সন্ধ্যানে বেরিয়ে পড়ার গল্প, উপন্যাস আছে। এটি মূলত শিক্ষামূলক ধ্রুপদি কল্পকাহিনি। গুপ্তধনের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া দলটি নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে বিভিন্ন রকমের শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করে। এসব দুর্যোগে বা যুদ্ধে তাদের শক্তি ও সম্পদের ক্ষয় হয়; কিছু সঙ্গী প্রাণ হারায়। যারা বেঁচে থাকে তাদেরও অনেকে আহত হয়। এর পর কোনো রহস্যময় দ্বীপে গিয়ে পৌঁছে। সেখানেও পায়ে পায়ে ওত পেতে আছে হাজারো বিপদ। অরণ্য-মানুষের আক্রমণ, হিংস্র জন্তুর আক্রমণ, অশরীরী আত্মার ভীতিসহ কত কী! এসব পার হতে আরও কিছু সঙ্গীর মৃত্যু হয়।
দলনেতার কাছে থাকে গোপন ও অতি মূল্যবান মানচিত্র। সেই মানচিত্র ধরে তারা এগোতে থাকে গুপ্তধনের গুহার দিকে। গুহা যতই কাছে আসছে বিপদ ততই বাড়ছে। শেষমেশ তারা যখন গুপ্তধনের কাছে পৌঁছে যায়, তখন মাত্র ক’জন সঙ্গী বেঁচে আছে। গুপ্তধনের পরিমাণ দেখে তাদের চোখ ছানাবড়া। গুহার এখানে-ওখানে স্বর্ণের বার সাজানো; এক পাশে বড় বড় পাত্রভর্তি হীরার দানা। বিভিন্ন আকার-আকৃতির অতি মূল্যবান গহনা। চতুর্দিকে শুধু হীরা, মানিক, সোনার ছড়াছড়ি। কে হবে এই বিপুল সম্পদের মালিক? এ নিয়ে তখন শুরু হয় নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ। শেষমেশ নিজেরা মারামারি করে একটা পক্ষ মারা পড়ে, অন্য পক্ষের বহুপ্রাণহানী হয়।
এ রকম সিনেমা দেখে খুব কষ্ট পেতাম। আহা! বেচারারা এত কষ্ট করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর সম্পদ উপভোগ করতে পারল না! কী দরকার ছিল একাই মালিক হওয়ার লোভে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে শেষ হয়ে যাওয়ার? এ প্রশ্নের মধ্যেই কৈশোরের চিন্তা ঘুরপাক খেত। এখন বুঝতে পাি ধ্রুপদি গল্প, সিনেমার মূল লক্ষ্য পাঠক ও দর্শকের অন্তরে এই বোধ জাগ্রত করা লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। গুপ্তধনের কাছে পৌঁছানোর আগমুহূর্ত পর্যন্ত সব বিপদ ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা এবং প্রতিবারই জয়লাভ। যখনই ঐক্য ভেঙে যায়, সবাই মারা পড়ে। অনৈক্যে শক্তি ক্ষয় এবং সবারই অকল্যাণ। ধ্রুপদি গল্প বা সিনেমার এটাই শিক্ষা। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের হয়েছে সেই দশা! যতদিন ফ্যাসিস্ট সরকার বিএনপি-জামাত, ডান-বাম তথা এককথায় সরকার ও আ’লীগ বিরোধীদের সমানে জেলে ঢুকাতো, খুন-গুম করতো, তখন ফ্যাসিস্ট বিরোধী সকালে এক কাতারে ছিল। আজ যখন অসংখ্য মানুষের জীবন ও অঙ্গহানীর বিনিময়ে দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছে, তখন যার যার আখের গুছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।
বিগত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের তরুণ ছাত্র-জনতার বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের অবসান ঘটে। কিন্তু গুপ্তধনের মালিক কে হবে, অর্থাৎ কে কোন পদে বসবে কিংবা কেন আমি কিছু পেলাম না; আমিও তো আন্দোলনে ছিলাম, এই আহাজারিতে বিপ্লবের ঐক্যে ছোট ছোট অসংখ্য ফাটল দেখা দিয়েছে। যে ত্যাগের মহিমায় প্রত্যয়ী হয়ে মৃত্যুকে বরণ করার জন্য পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল ছাত্র-জনতা; হাসিনা-সরকারের পতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই আত্মত্যাগের শপথ, দেশপ্রেমের প্রত্যয় হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
গুপ্তধন এখন হাতের মুঠোয়। কাজেই যে যতটা পার লুটে নাও। যারা পাচ্ছে না তাদের কণ্ঠে হতাশা; আমি কেন পেলাম না! যারা পায়নি, তারা দিনরাত সবাইকে গালমন্দ করছে। কেউ বলছে না এটা পাওয়ার সময় নয়। মনে রাখতে হবে, আমরা এখনও যুদ্ধের মধ্যেই। এখনও আমাদের শুধুই দেওয়ার সময়। এখন আমরা সবাই দাতা; গ্রহীতা শুধু দীর্ঘ দিনের বঞ্চিত-ক্ষুধার্ত বাংলাদেশ। যারা বিভিন্ন পদ-পদবি পেয়েছেন, তারাও সামনে এসে বলছেন না দেখ ভাই, আগে রাজপথে থেকে যুদ্ধ করেছি, এখন সচিবালয়ে গিয়ে যুদ্ধ করছি। আমাদের যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। আমরাও তোমাদের মতো যুদ্ধের মাঠেই আছি। তোমরা আছ রাজপথে, আমরা সচিবালয়েএটুকুই শুধু পার্থক্য। এমনকি সরকার ও সচিবলায়ে থেকে ফ্যাসিস্টদের সাজানো ও তাদের আজ্ঞাবহ হাজারো কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে যুদ্ধ করে যেতে হচ্ছে। যারা সচিবালয়ে আছেন তাদের উচিত হবে গরিব দেশের মানুষের সামনে বিলাসী জীবনযাপন প্রদর্শন না করা; দামি ফোন, মাথায় ছাতাধরা লোক, দামি গাড়িতে চড়া, দামি পোশাক ইত্যাদি পরিহার করা। যাতে রাজপথের সহযোদ্ধারা তাদের উঁচু শ্রেণির মানুষ ভেবে ঈর্ষাকাতর হওয়ার সুযোগ না পায়। শুধু মুখে মিষ্টি কথা বললে মানুষ বিশ্বাস করবে না। তাদের প্রতিটা পদক্ষেপে প্রমাণ করতে হবে তারা এখনও রাজপথের যোদ্ধাদের মতোই সাধারণ বিপ্লবী। এদের আর তাদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো পার্থক্য নেই। এটা নিশ্চিত করতে না পারলে গুপ্তধন, মানে পদ-পদবির লোভ, নিজেদের মধ্যে মারামারিতে গণঅভ্যুত্থানের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। নতুন ফর্মে নতুন কোনো ফ্যাসিবাদ আগের ফ্যাসিবাদের স্থলাভিষিক্ত হবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্র সংস্কারের এক মহান শপথ নিয়ে; এ দেশের মানুষকে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে অন্তর্বতীকালীন সরকার তার জনআকাক্সক্ষার যাত্রা শুরু করেছে। আইনের দোহাই দিয়েই হোক কিংবা রাজনৈতিক শক্তির ভয়েই হোক, সেখান থেকে এক চুলও বিচ্যুত হওয়া যাবে না। সুযোগ হাতছাড়া হলে মাশুল দিতে হবে সকলকেই।
বিলাল মাহিনী, সাহিত্য সম্পাদক : বাংলাদেশ পেশাজীবী অধিকার পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি, নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর।